সন্ধি বিচ্ছেদ

সন্ধি শব্দের অর্থ ‘মিলন’। সন্নিহিত দুটি ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে। যেমন: হিম + আলয় = হিমালয়; এখানে দুটি সন্নিহিত ধ্বনি ‘হিম’ ও ‘আলয়’ মিলে ‘হিমালয়’ শব্দটি গঠন করেছে। সন্ধি শব্দের বিশেষণাত্মক রূপ হল সম+ধৃ; অর্থাৎ  সমভাবে যা ধারণ করে। যেহেতু ধ্বনির মিলনই সন্ধি তাই সন্ধি ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্বে আলোচিত হয়।

ভাষার শব্দগুলোকে দ্রুত উচ্চারণের সুবিধার্থে অনেক সময় বক্তা পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক ধ্বনিকে একত্রে উচ্চারণ করেন। এরকম উচ্চারণগুলো মূলত ধ্বনিসমূহের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বক্তার অবচেতনে হয়ে থাকে। এরূপ মিলনের ফলে বিদ্যমান ধ্বনির রূপান্তর, লোপ বা বিকৃতি হয়। কালক্রমে এরকম উচ্চারণগুলো নতুন শব্দ হিসেবে ভাষায় তার নিজস্ব স্থান করে নেয়। এভাবে নতুন শব্দ গঠনের প্রক্রিয়াই সন্ধি।

সন্ধির উদ্দেশ্য হল স্বাভাবিক উচ্চারণে সহজপ্রবণতা ও ধ্বনিগত মাধুর্য সম্পাদন। উপরের উদাহরণে ‘হিমালয়’ শব্দটি ‘হিম আলয়’ উচ্চারণের তুলনায় সহজ এবং শ্রুতিমধুর। অর্থ্যাৎ সন্ধির প্রধান সুবিধা হল শব্দ উচ্চারণের সুবিধা। তবে যেসব ক্ষেত্রে আয়াসের লাঘব হয় কিন্তু ধ্বনি-মাধুর্য রক্ষিত হয় না, সেসব ক্ষেত্রে সন্ধি করার নিয়ম নেই। যেমন: কচু + আদা + আলু = কাচ্চাদালু হয় না। কারণ ‘কাচ্চাদালু’ বলা বা উচ্চারণ করা সহজ কিন্তু এতে ধ্বনি মাধুর্য রক্ষিত হয় না।

font-style: inherit; font-weight: 700; text-align: var(--stk-alignment-text-align,start); text-decoration-line: underline;">সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য

সহজ ভাষায় সন্ধি হল ধ্বনি সমূহের মিলন আর সমাস হল পদ সমূহের মিলন।


বাংলা সন্ধি দুই রকমের। 
যথা: স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি। 
অপরপক্ষে তৎসম শব্দের সন্ধি তিন প্রকার। যথা: স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি। 
বাংলা ভাষায় বহু তৎসম শব্দ আছে। তাই বিসর্গসন্ধিও বাংলা ব্যাকরণের আলচ্য বিষয়।

বাংলা স্বরসন্ধি

স্বরধ্বনির সাথে স্বরধ্বনি মিলে যে সন্ধি হয় তাকে স্বরসন্ধি বলে  যদিও বাংলায় মৌলিক স্বরধ্বনি সংখ্যা মাত্র সাতটি (অ, আ, ই, ঈ, উ, এ, ও, এ্যা) কিন্তু প্রচলিত সন্ধির নিয়মাবলীর ভিতরে ১১টি স্বরবর্ণেরই ব্যবহার পাওয়া যায়। উল্লেখ্য ‘এ্যা’ নামক কোন বর্ণ বাংলা বর্ণমালায় না থাকলেও সন্ধিজাত শব্দে পাওয়া যায়। যেমন: অতি + আচার = অত্যাচার।

স্বরসন্ধিতে দুটি সন্নিহিত স্বরের একটি লোপ পায়। যেমন: অ + এ = এ; শত + এক = শতেক, এখানে ‘শত’ শব্দের শেষে ‘অ’ এবং ‘এক’ শব্দের প্রথমে ‘এ’ স্বর মিলিত হয়ে ‘শতেক’ শব্দে ‘ত’ এর সাথে ‘এ (কার)’ হিসেবে মিলিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ ‘অ’ লোপ পেয়ে অ + এ = এ (কার) হয়েছে। এরূপ আরও উদাহরণ হল – কতেক, শাঁখারি, রূপালি, মিথ্যুক, হিংসুক, নিন্দুক, কুড়িক, ধনিক, গুটিক, আশির, নদীর ইত্যাদি।

  • শাখা + আরি = শাঁখারি (আ + আ = আ); ‘শাখা’ শব্দের শেষের ‘আ’ এবং ‘আরি’ শব্দের প্রথমের ‘আ’ স্বর মিলিত হয়ে ‘শাখ’ এর ‘খ’ বর্ণের সাথে ‘আ’ হিসেবে যুক্ত হয়ে ‘শাঁখারি’ শব্দ গঠন করেছে।
  • নিন্দা + উক = নিন্দুক (আ + উ = উ); ‘নিন্দা’ শব্দের শেষের ‘আ’ এবং ‘উক’ শব্দের প্রথমের ‘উ’ স্বর মিলিত হয়ে ‘নিন্দ’ এর ‘ন্দ’ এর সাথে ‘উ’ হিসেবে যুক্ত হয়ে ‘নিন্দুক’ শব্দ গঠন করেছে।
  • অনুরুপভাবে, গুটি + এক = গুটিক (ই + এ = ই)।

কোন কোন স্থানে পাশাপাশি দুটি স্বরের শেষেরটি লোপ পায়। যেমন: যা + ইচ্ছা + তাই = যাচ্ছেতাই; এখানে ‘যা’ এ ‘আ’ এবং ‘ইচ্ছা’ এর ‘ই’ যুক্ত হয়ে ‘আ’ হিসেবে মিলিত হয়েছে। অর্থ্যাৎ আ + ই = আ যেখানে ‘ই’ লোপ পেয়েছে।

বাংলা স্বরসন্ধির আরও কিছু উদাহরণ-

অর্ধ + এক = অর্ধেক (ও + এ = এ)এত + এক = এতেক (ও + এ = এ)
গোঁড়া + আমি = গোঁড়ামিমিতা + আলি = মিতালি
গোলা + আন্দাজ = গোলন্দাজঘড়ি + ইয়াল = ঘড়িয়াল
খাসি + ইয়া = খাসিয়াআলো + এ = আলোয়
ছায়া + এ = ছায়ায় চা + এ = চায়ে
ভাল + এ = ভালয়বাবু + আনা = বাবুয়ানা
মন + উপযোগী = মনোপযোগীমন + অন্তর = মনান্তর
মন + অধীন = মনাধীনযশ + আকাঙ্ক্ষা = যশাকাঙ্ক্ষা

বাংলা ব্যাঞ্জনসন্ধি8

স্বরে আর ব্যঞ্জনে, ব্যঞ্জনে আর ব্যঞ্জনে এবং ব্যঞ্জনে আর স্বরে মিলিত হয়ে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জন সন্ধি বলে। প্রকৃত বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি সমীভবনের নিয়মে হয়ে থাকে এবং সেটি মূলত কথ্যরীতিতে সীমাবদ্ধ।

  • প্রথম ধ্বনি অঘোষ এবং পরবর্তী ধ্বনি ঘোষ হলে, দুটি মিলে ঘোষ ধ্বনি দ্বিত্ব হয়। অর্থ্যাৎ সন্ধিতে ঘোষ ধ্বনির পূর্ববর্তী অঘোষ ধ্বনিও ঘোষ হয়। যেমন: ছোট + দা = ছোড়দা; এখানে ট-অঘোষ ধ্বনি ও দ-ঘোষ ধ্বনি এর মিলনের ফলে সৃষ্ট নতুন শব্দে অঘোষ ধ্বনি (ট) এর জায়গায় ঘোষ ধ্বনি (ড়) বসেছে অর্থ্যাৎ ট + দ = ড়।
  • হলন্ত র্ ধ্বনির পরে অন্য ব্যঞ্জন ধ্বনি থাকলে র্ লুপ্ত হয়ে পরবর্তী ধ্বনি দ্বিত্ব বা দুইবার হয়। যেমন: আর্ + না = আন্না, চার + টি = চাট্টি, ধর্ + না = ধন্না, দুর্ + ছাই = দুচ্ছাই ইত্যাদি।
  • চ-বর্গীয় ধ্বনির আগে যদি ত-বর্গীয় ধ্বনি আসে তাহলে, ত-বর্গীয় ধ্বনি লোপ হয় এবং চ-বর্গীয় ধ্বনির দ্বিত্ব হয়। যেমন: নাত + জামাই = নাজ্জামাই (ত + জ = জ্জ), বদ্ + জাত = বজ্জাত, হাত + ছানি = হাচ্ছানি ইত্যাদি।
  • প’ এর পরে ‘চ’ এবং ‘স’ এর পরে ‘ত’ এলে চ ও ত এর স্থলে শ হয়। যেমন: পাঁচ + শ = পাঁশ্শ, সাত + শ = সাশ্শ, পাঁচ + সিকা = পাঁশ্শিকা।
  • হলন্ত ধ্বনির সাথে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে স্বরের লোপ হয় না। যেমন: চুন + আরি = চুনারি, তিল + এক = তিলেক, বার + এক = বারেক, তিন + এক = তিনেক।
  • স্বরধ্বনির পরে ব্যঞ্জনধ্বনি এলে স্বরধ্বনিটি লুপ্ত হয়। যেমন: কাঁচা + কলা = কাঁচকলা (আ + ক = ক), ঘোড়া + দৌড় = ঘোড়দৌড় (আ + দ = দ), ঘোড়া + গাড়ি = ঘোড়গাড়ি ইত্যাদি।

তৎসম শব্দের সন্ধি

তৎসম শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ হচ্ছে তৎ (তার) + সম যার অর্থ তার সমান; অর্থ্যাৎ সংস্কৃতের সমান। বাংলা ভাষায় বহু সংস্কৃত শব্দ অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এসব তৎসম শব্দগুলোর সন্ধি বিচ্ছেদ সংস্কৃত ভাষার নিয়মেই সম্পাদিত হয়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম সন্ধি ৩ প্রকার। যথা: স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি।

তৎসম স্বরসন্ধি

বাংলা শব্দের মত এখানেও স্বরধ্বনির সাথে স্বরধ্বনি মিলে যে সন্ধি হয় তাকে স্বরসন্ধি বলে। তৎসম স্বরসন্ধি গঠনের নিয়ম –

অ-কার কিংবা আ-কারের পর অ-কার কিংবা আ-কার থাকলে উভয়ে মিলে আ-কার হয়। আ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন: হিম + অচল = হিমাচল (অ + অ = আ)। অনুরূপভাবে-

প্রাণ + অধিক = প্রাণাধিক (অ + অ = আ)হস্ত + অন্তর = হস্তান্তর (অ + অ = আ)
হিত + অহিত = হিতাহিত (অ + অ = আ)নব + অন্ন = নবান্ন (অ + অ = আ)
দেশ + অন্তর = দেশান্তর (অ + অ = আ)স্ব + অধীন = স্বাধীন (অ + অ = আ)
পর + অধীন = পরাধীন (অ + অ = আ)সিংহ + আসন = সিংহাসন (অ + আ = আ)
স্ব + আয়ত্ব = স্বায়ত্ত (অ + আ = আ)হিম + আলয় = হিমালয় (অ + আ = আ)
দেব + আলয় = দেবালয় (অ + আ = আ)রত্ন + আকর = রত্নাকর (অ + আ = আ)
জল + আধার = জলাধার (অ + আ = আ)দণ্ড + আদেশ = দণ্ডাদেশ (অ + আ = আ)
যথা + অর্থ = যথার্থ (আ + অ = আ)আশা + অতীত = আশাতীত (আ + অ = আ)
কথা + অমৃত = কথামৃত (আ + অ = আ)মহা + অর্ঘ = মহার্ঘ (আ + অ = আ)
যথা + অযথ = যথাযথ (আ + অ= আ)ত্বরা + অন্বিত = ত্বরান্বিত (আ + অ = আ)
বিদ্যা + আলয় = বিদ্যালয় (আ + আ = আ)কারা + আগার = কারাগার (আ + আ = আ)
মহা + আশয় = মহাশয় (আ + আ = আ)সদা + আনন্দ = সদানন্দ (আ + আ = আ)
ব্যথা + আতুর = ব্যথাতুর (আ + অ = আ)ভাষা + আচার্য = ভাষাচার্য (আ + অ = আ)

অ-কার কিংবা আ-কারের পর ই-কার বা ঈ-কার থাকলে উভয়ে মিলে এ-কার হয়। এ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: শুভ + ইচ্ছা = শুভেচ্ছা।

স্ব + ইচ্ছা = স্বেচ্ছা (অ + ই = এ)নর + ইন্দ্র = নরেন্দ্র (অ + ই = এ)
পূর্ণ + ইন্দু = পূর্ণেন্দুকৃষ্ণ + ইন্দু = কৃষ্ণেন্দু
শ্রবণ + ইন্দ্রিয় = শ্রবণেন্দ্রিয়জিত + ইন্দ্রিয় = জিতেন্দ্রিয়
যথা + ইষ্ট = যথেষ্টযথা + ইচ্ছা = যথেচ্ছা (আ + ই = এ)
রসনা + ইন্দ্রিয় = রসনেইন্দ্রিয় (আ + ই = এ)মহা + ইন্দ্র = মহেন্দ্র
পরম + ঈশ = পরমেশ (অ + ঈ = এ) গণ + ঈশ = গণেশ (অ +ঈ = এ)
ভব + ঈশ = ভবেশরাজ্য + ঈশ্বর = রাজ্যেশ্বর
মহা + ঈশ = মহেশ (আ + ঈ = এ)মহা + ঈশ্বর = মহেশ্বর (আ + ঈ = এ)

অ-কার কিংবা আ-কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ও-কার হয়। ও-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: সূর্য + উদয় = সূর্যোদয়।

সর্ব + উচ্চ = সর্বোচ্চ (অ + উ = ও)দীর্ঘ + উচ্চারণ = দীর্ঘোচ্চারণ (অ + উ = ও)
প্রশ্ন + উত্তর = প্রশ্নোত্তর (অ + উ = ও) উত্তর + উত্তর = উত্তরোত্তর (অ + উ = ও)
যথা + উচিত = যথোচিত (আ + উ = ও)যথা + উপযুক্ত = যথোপযুক্ত (আ + উ = ও)
কথা + উপকথন = কথোপকথন (আ + উ = ও)মহা + উৎসব = মহোৎসব (আ + উ = ও)
গৃহ + ঊর্ধ্ব = গৃহোর্ধ্ব (অ + ঊ = ও)সর্ব + ঊর্ধ্ব = সর্বোর্ধ্ব (অ + ঊ = ও)
নব + ঊঢ়া = নবোঢ়া (অ + ঊ = ও)গঙ্গা + ঊর্মি = গঙ্গোর্মি (আ + ঊ = ও)
মহা + ঊর্ধ্ব = মহোর্ধ্ব (আ + ঊ = ও)

অ-কার কিংবা আ-কারের পর ঋ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ‘অর’ হয়। এটি রেফ রূপে পরবর্তী বর্ণের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: মহা+ঋষি =মহর্ষি। অনুরূপভাবে-

  • সপ্ত + ঋষি = সপ্তর্ষি (অ + ঋ = অর্)
  • উত্তম + ঋণ = উত্তমর্ণ (অ + ঋ = অর্)
  • মহা + ঋষি = মহোর্ষি (আ + ঝ = অর্)
  • রাজা/রাজন্ + ঋষি = রাজর্ষি (আ + ঝ = অর্)

অ-কার কিংবা আ-কারের পর ‘ঋত’ থাকলে উভয়ে মিলে ‘আর’ হয়। এক্ষেত্রে বানানের পূর্ববর্তী বর্ণের সাথে আ-কার এবং রেফ রূপে পরবর্তী বর্ণের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: শীত + ঋত = শীতার্ত। অনুরূপভাবে-

  • দুঃখ + ঋত = দুঃখার্ত (অ+ঋত = আর)
  • শোক + ঋত = শোকার্ত (অ+ঋত = আর)
  • তৃষ্ণা + ঋত = তৃষ্ণার্ত (আ+ঋত = আর)
  • ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত (আ+ঋত = আর)

অ-কার কিংবা আ-কারের পর এ-কার কিংবা ঐ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঐ-কার হয়। ঐ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: জন + এক = জনৈক। অনুরূপভাবে-

  • হিত + এষী = হিতৈষী (অ + এ = ঐ)
  • তথা + এবচ = তথৈবচ
  • মত + ঐক্য = মতৈক্য
  • মহা + ঐক্য = মহৈক্য ইত্যাদি।

অ-কার কিংবা আ-কারের পর ও-কার কিংবা ঔ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঔ-কার হয়। ঔ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: বন + ঔষধি = বনৌষধি। অনুরূপভাবে-

  • জল + ওকা = জলৌকা (অ + ও = ঔ)
  • জল + ওঘ = জলৌঘ
  • মহা + ঔষধি = মহৌষধি
  • চিত্ত + ঔদার্য = চিত্তৌদার্য
  • মহা + ঔদার্য = মহৌদার্য ইত্যাদি।

ই-কার কিংবা ঈ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঈ-কার হয়। ঈ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: অতি + ইত = অতীত। অনুরূপভাবে-

  • অতি + ইব = অতীব (ই + ই = ঈ)
  • রবি + ইন্দ্র = রবীন্দ্র
  • পরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা
  • গিরি + ঈশ = গিরীশ
  • যোগী + ইন্দ্র = যোগীন্দ্র
  • অধি + ঈশ্বর = অধীশ্বর ইত্যাদি।

ই-কার কিংবা ঈ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার ভিন্ন অন্য স্বর থাকলে উভয়ে মিলে ‘য’ বা য-ফলা হয়। য-ফলা পূর্ববর্তী বর্ণের সাথে যুক্ত হয়। যেমন: অতি + অন্ত = অত্যন্ত (উ + উ = ঊ)। অনুরূপভাবে-

ই + আ = য্ + অ

  • বি + অবস্থা = ব্যবস্থা
  • অধি + অক্ষ = অধ্যক্ষ
  • আদি + অন্ত = আদ্যন্ত
  • অতি + অধিক = অত্যধিক
  • ইতি + আদি = ইত্যাদি
  • যদি + অপি = যদ্যপি
  • পরি + অন্ত = পর্যন্ত
  • অতি + আচার = অত্যাচার
  • প্রতি + আশা = প্রত্যাশা
  • প্রতি + আবর্তন = প্রত্যাবর্তন
  • প্রতি + উত্তর = প্রত্যুত্তর
  • উপরি + উপরি = উপর্যুপরি
  • অভি + উত্থান = অভ্যুত্থান
  • প্রতি + উপকার = প্রত্যুপকার



ই + আ = য্ + আ

ই + উ = য্ + উ

এছাড়া প্রতি + ঊষ = প্রত্যুষ (ই+ঊ=য+ঊ), প্রতি + এক = প্রত্যেক (ই+এ=য্+এ), নদী + অম্বু = নদ্যম্বু (ঈ+অ=য্+অ) ইত্যাদি।

উ-কার কিংবা ঊ-কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ঊ-কার হয়। ঊ-কার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন: মরূ + ঊদ্যান = মরূদ্যান। অনুরূপভাবে-

  • কটু + উক্তি = কটূক্তি (উ + উ = ঊ)
  • অনু + উদিত = অনূদিত (উ + উ = ঊ)
  • বহু + ঊর্ধ্ব = বহুর্ধ্ব (উ + ঊ = ঊ)
  • তনু + ঊর্ধ্ব = তনূর্ধ্ব (উ + ঊ = ঊ)
  • বধূ + উক্তি = বধূক্তি (ঊ + উ = ঊ)
  • ভূ + ঊর্ধ্ব = ভূর্ধ্ব (ঊ + ঊ = ঊ)

উ-কার কিংবা ঊ-কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার ভিন্ন অন্য স্বর থাকলে উভয়ে মিলে ব-ফলা হয়। ব-ফলা পূর্ববর্তী বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন: সু + অল্প = স্বল্প (উ + অ = ব + অ)। অনুরূপভাবে-

  • অনু + অয় = অন্বয় (উ + অ = ব + অ)
  • সু + আগত = স্বাগত (উ + আ = ব + আ)
  • অনু + ইত = অন্বিত (উ + ই = ব + ই)
  • তনু + ঈ = তন্বী (উ + ঈ = ব + ঈ)
  • অনু + এষণ = অন্বেষণ (উ + এ = ব + এ)

ঋ-কারের পর ঋ ভিন্ন অন্য স্বর থাকলে ঋ-এর স্থলে র-হয় এবং র-ফলা পূর্ববর্তী বর্ণের সঙ্গে যুক্ত হয়। যেমন: পিতৃ + আদেশ = পিত্রাদেশ।

এ, ঐ, ও, ঔ-কারের পর এ, ঐ স্থানে যথাক্রমে অয়, আয় এবং ও, ঔ স্থানে যথাক্রমে অব্ ও আব্ হয়। যেমন: নে + অন = নয়ন (এ + অ = অয়্ + অ), পৌ + অক = পাবক, পো + অন = পবন, গো + এষণা = গবেষণা, নৌ + ইক = নাবিক ইত্যাদি।

একনজরে উপরিউক্ত (তৎসম স্বরসন্ধির) নিয়মগুলো-

অ/আ + অ/আ = আ
অ/আ + ই/ঈ = এ
অ/আ + উ/ঊ = ও
অ/আ + ঋ = অর (রেফ)
অ/আ + ঋত = আর (পূর্ববর্তী বর্ণের সাথে আ-কার ও পরবর্তী বর্ণের সাথে রেফ)
অ/আ + এ/ঐ = ঐ
অ/আ + ও/ঔ = ঔ
ই/ঈ + ই/ঈ = ঈ
ই/ঈ + ই/ঈ ব্যতিত অন্য স্বর = য-ফলা(্য) + অন্য স্বর
উ/ঊ + উ/ঊ = ঊ
উ/ঊ + উ/ঊ ব্যতিত অন্য স্বর = ব-ফলা + অন্য স্বর
ঋ + ঋ ভিন্ন অন্য স্বর = র-ফলা + অন্য স্বর

তৎসম ব্যাঞ্জনসন্ধি

(সংজ্ঞা একই) স্বরে আর ব্যঞ্জনে, ব্যঞ্জনে আর ব্যঞ্জনে এবং ব্যঞ্জনে আর স্বরে মিলিত হয়ে যে সন্ধি হয় তাকে ব্যঞ্জন সন্ধি বলে। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের মিলনের প্রকৃতি অনুসারে এই সন্ধির নিয়ম নিম্নরূপ-

ব্যাঞ্জনধ্বনি + স্বরধ্বনি

ক্, চ্, ট্, ত্, প্ এর পরে স্বরসন্ধি থাকলে সেগুলো যথাক্রমে গ্, জ্, ড্, দ্, ব্ হয়। পরবর্তী স্বরধ্বনিটি পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে যুক্ত হয়। যেমন: দিক্ + অন্ত = দিগন্ত (ক্ + অ = গ্), ণিচ্ + অন্ত = ণিজন্ত (চ্ + অ = জ) ইত্যাদি।

স্বরধ্বনি + ব্যাঞ্জনধ্বনি

স্বরধ্বনির পর ছ থাকলে উক্ত ব্যাঞ্জনধ্বনিটি দ্বিত্ব হয়। যেসন: এক + ছত্র = একচ্ছত্র (অ+ছ = চ্ছ)।

ব্যাঞ্জনধ্বনি + ব্যাঞ্জনধ্বনি

ত্ ও দ্ – এর পর চ্ ও ছ্ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে চ্ হয়। যেমন: সৎ + চিন্তা = সচ্চিন্তা (ত্ + চ = চ্চ), উৎ + ছেদ = উচ্ছেদ (ত+ছ=চ্ছ)।

ত্ ও দ্ – এর পর জ্ ও ঝ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে জ্ হয়। যেমন: সৎ + জন = সজ্জন (ত্ + জ্ = জ্জ), কুৎ + ঝটিকা = কুজ্ঝটিকা (ত+ঝ=জ্ঝ)।

ত্ ও দ্ – এর পর শ্ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে চ্ এবং শ্ এর স্থানে ছ উচ্চারিত হয়। যেমন: উৎ + শ্বান = উচ্ছাস (ত্ + শ = চ্ + ছ = চ্ছ)।

ত্ ও দ্ – এর পর ড্ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে ড্ হয়। যেমন: উৎ + ডীন = উড্ডীন (ত্ + ড = ড্ড)

ত্ ও দ্ – এর পর হ্ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে দ এবং হ এর স্থানে ধ্ উচ্চারিত হয়। যেমন: উৎ + হার = উদ্ধার (ত্ + হ = দ্ + ধ = দ্ধ)।

ত্ ও দ্ – এর পর ল্ থাকলে ত্ ও দ্ এর স্থানে ল্ উচ্চারিত হয়। যেমন: উৎ + লাস = উল্লাস (ত্ + ল = ল্ল)


ব্যঞ্জন ধ্বনিসমূহের যে কোনো বর্গের অঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনির পর যে কোনো বর্গের ঘোষ অল্পপ্রাণ ও ঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি কিংবা ঘোষ অল্পপ্রাণ তালব্য ধ্বনি, (য > জ), ঘোষ অল্পপ্রাণ ওষ্ঠ ধ্বনি (ব), ঘোষ কম্পনজাত দন্তমূলীয় ধ্বনি (র) কিংবা ঘোষ অল্পপ্রাণ ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জনধ্বনি (ব) থাকলে প্রথম অঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনি ঘোষ অল্পপ্রাণরূপে উচ্চারিত হয়। যেমন: উৎ + যোগ = উদ্যোগ।

ঙ, ঞ, ণ, ন, ম পরে থাকলে পূর্ববর্তী অঘোষ অল্পপ্রাণ স্পর্শধ্বনি সেই বর্গীয় ঘোষ স্পর্শধ্বনি কিংবা নাসিক্য ধ্বনি হয়। যেমন: তৎ + মধ্যে = তন্মধ্যে।

ম্ এর পর যে কোনো বর্গীয় ধ্বনি থাকলে ম্ ধ্বনিটি সেই বর্গের নাসিক্য ধ্বনি হয়। যেমন: সম্ + চয় = সঞ্চয়।

ম্- এর পর অন্তঃস্থ ধ্বনি য, র, ল, ব, কিংবা শ. ষ, স, ঞ থাকলে, ম্ স্থলে অনুস্বার(ং) হয়। যেমন: সম্ + যম = সংযম।

চ্ ও জ্ – এর পরে নাসিক্য ধ্বনি তালক্য হয়। যেমন: রাজ + নী = রাজ্ঞী (চ্ + ন = চ্ + জ)।

দ্ ও ধ্ এর পরে স্ থাকলে, দ্ ও ধ্ এর স্থলে অঘোষ অল্পপ্রাণ ধ্বনি হয়। যেমন: বিপদ্ + সংকুল = বিপৎসংকুল।

ষ্ – এর পরে ত্ বা থ্ থাকলে, যথাক্রমে ত্ ও থ্ স্থানে ট ও ঠ হয়। যেমন: ষ্ষ + থ = ষষ্ঠ।

বিশেষ নিয়মে সাধিত কতগুলো সন্ধি-

উৎ + স্থান = উত্থান, সম্ + কার = সংস্কার, উৎ + স্থাপন = উত্থাপন, সম্ + কৃত = সংস্কৃত, পরি + কার = পরিষ্কার।

বিসর্গ সন্ধি

সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে পদের অন্তস্থিত র্ ও স্ অনেক ক্ষেত্রে অঘোষ উষ্মধ্বনি অর্ধ্যৎ হ ধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয় এবং তা বিসর্গ (ঃ) রূপে লেখা হয়। র্ ও স্ বিসর্গ ব্যঞ্জনধ্বনিমালার অন্তর্গত। সে কারণে বিসর্গ সন্ধি ব্যঞ্জনসন্ধির অন্তর্গত। বস্তুত বিসর্গ র্ ও স্ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বিসর্গকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা:

  • র-জাত বিসর্গ: র-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে র-জাত বিসর্গ বলে। যেমন: অন্তর – অন্তঃ।
  • স-জাত বিসর্গ: স-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাকে স-জাত বিসর্গ বলে। যেমন: শিরস্ – শিরঃ।

বিসর্গের সাথে অর্থ্যাৎ র্ ও স্ -এর সাথে স্বরধ্বনি কিংবা ব্যঞ্জনধ্বনির যে সন্ধি হয় তাকে বিসর্গ সন্ধি বলে। বিসর্গ সন্ধি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

  • বিসর্গ + স্বর


  • বিসর্গ + ব্যঞ্জনবিসর্গ + স্বর

    অ-ধ্বনির পরস্থিত (অঘোষ উষ্মধ্বনি) বিসর্গের পর অ ধ্বনি থাকলে অ + ঃ + অ – এ তিনে মিলে ও-কার হয়। যেমন: ততঃ + অধিক = ততোধিক।

    বিসর্গ + ব্যঞ্জন

    অ-কারের পরস্থিত স্-জাত বিসর্গের পর ঘোষ অল্পপ্রাণ ও ঘোষ মহাপ্রাণ ব্যঞ্জনধ্বনি, নাসিক্যধ্বনি কিংবা অন্তস্থ য, অন্তস্থ ব, র, ল, হ থাকলে অ-কার ও স্-জাত বিসর্গ উভয় স্থলে ও-কার হয়। যেমন: মনঃ + হর = মনহর।

    অ-কারের পরস্থিত র্-জাত বিসর্গের পর উপর্যুক্ত ধ্বনিসমূহের কোনোটি থাকলে বিসর্গ স্থানে ‘র’ হয়। যেমন: অন্তঃ + গত = অন্তর্গত।

    অ ও আ ভিন্ন অন্য স্বরের পরে বিসর্গ থাকলে এবং তার সঙ্গে অ, আ, বর্গীয় ঘোষ অল্পপ্রাণ ও ঘোষ মহাপ্রাণ নাসিক্যধ্বনি কিংবা য, র, ল, ব, হ- এর সন্ধি হলে বিসর্গ স্থানে ‘র’ হয়। যেমন: নিঃ + আকার = নিরাকার।

    বিসর্গের পর অঘোষ অল্পপ্রাণ কিংবা মহাপ্রাণ তালব্য ব্যঞ্জন থাকলে বিসর্গের স্থলে তালব্য শিশ্ ধ্বনি হয়, অঘোষ অল্পপ্রাণ কিংবা অঘোষ মহাপ্রাণ মূর্ধন্য ব্যঞ্জন থাকলে বিসর্গ স্থলে মূর্ধন্য শিশ ধ্বনি হয়, অঘোষ অল্পপ্রাণ কিংবা অঘোষ মহাপ্রাণ দন্ত্য ব্যঞ্জনের স্থলে দন্ত্য শিশ ধ্বনি হয়। যেমন: নিঃ + চয় = নিশ্চয় (ঃ + চ/ছ = শ + চ/ছ)।

    অঘোষ অল্পপ্রাণ ও অঘোষ মহাপ্রাণ কিংবা ওষ্ঠ্য ব্যঞ্জন (ক, খ, প, ফ) পরে থাকলে অ বা আ ধ্বনির পরস্থিত বিসর্গ স্থলে অঘোষ দন্ত্য শিশ ধ্বনি (স্) হয় এবং অ বা আ ব্যতীত অন্য স্বরধ্বনির পরস্থিত বিসর্গ স্থলে অঘোষ মূর্ধন্য শিশ্ ধ্বনি (ষ) হয়। যেমন: নমঃ + কার = নমস্কার, পুরঃ + কার = পুরস্কার, আবিঃ + কার = আবিষ্কার ইত্যাদি।

    কোন কোন ক্ষেত্রে সন্ধির বিসর্গ লোপ হয় না। যেমন: প্রাতঃ + কাল = প্রাতঃকাল।

    যুক্ত ব্যঞ্জন ধ্বনি স্ত, স্থ কিংবা স্প পরে থাকলে পূর্ববর্তী বিসর্গ অবিকৃত থাকে অথবা লোপ পায়। যেমন: নিঃ + স্তব্ধ = নিঃস্তব্ধ।

    কয়েকটি বিশেষ বিসর্গ সন্ধি-

    বাচঃ + পতি = বাচস্পতি, ভাঃ + কর = ভাস্কর, অহঃ + নিশা = অহর্নিশ, অহঃ +অহ = অহঅহ।

    নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি

    যে সন্ধিগুলো সন্ধির প্রচলিত নিয়মগুলো মেনে চলে না, তাদের নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি বলে। তবে শুধুমাত্র তৎসম শব্দেই নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি হয়। যেমন –

    স্বরসন্ধি

    • কুল + অটা = কুলাটা
    • প্র + ঊঢ় = প্রৌঢ়
    • অন্য + অন্য = অন্যান্য
    • গো + অক্ষ = গবাক্ষ
    • গো + ইন্দ্র = গবেন্দ্র
    • মার্ত + অণ্ড = মার্তণ্ড
    • শার + অঙ্গ = শারজ্ঞ
    • শুদ্ধ + ওদন = শুদ্ধোদন
    • স্ব + ঈর = স্বৈর

    ব্যঞ্জন সন্ধি

    • আ + চর্য = আশ্চর্য
    • গো + পদ = গোষ্পদ
    • বন্ + পতি = বনস্পতি
    • বৃহৎ + পতি = বৃহস্পতি
    • দিব্ + লোক = দ্যুলোক
    • তৎ + কর = তস্কর
    • পর্ + পর = পরস্পর
    • মনস্ + ঈষা = মনীষা
    • ষট্ + দশ = ষোড়শ
    • এক্ + দশ = একাদশ।



Next Post Previous Post
1 Comments
  • Anonymous
    Anonymous March 23, 2023 at 9:21 PM

    Nice

Add Comment
comment url