বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ আলোচনা করুন

বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশ 





এই পর্বে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে আসামের রাজাকে লেখা কোচবিহারের রাজার একটি পত্রকে বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ধরা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে দোম আন্তনিও নামে এক পাদ্রি রচিত ব্রাহ্মণ- রােমান-ক্যাথলিক-সংবাদ গ্রন্থটি বাংলা গদ্যের প্রাথমিক চেষ্টার নিদর্শন বিবেচনা করা হয়। বাঙালির লেখা প্রথম মুদ্রিত এই গ্রন্থটি ১৭৪৩ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে রােমান অক্ষরে মুদ্রিত হয়। 

১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে রােমান ক্যাথলিক পতুগিজ পাদ্রি মানােএল দা আসসুম্পাঁও কর্তৃক রােমান হরফে রচিত 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ' বাংলা গদ্যের প্রাথমিক প্রচেষ্টার আরও একটি নিদর্শন। এই গ্রন্থটিকে বাংলা কথ্য ভাষার আদি গ্রন্থ বলা হয় [২৯তম বিসিএস)। 

পতুগিজ পাদ্রি মানােএল দা আসসুম্পাঁও পর্তুগিজ ভাষায় একটি ব্যাকরণ ও একটি শব্দকোষ প্রণয়ন করেন। ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে লিসবন থেকে প্রকাশিত ব্যাকরণটি বাংলা ব্যাকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর নামে প্রচলিত ব্যাকরণ ও শব্দকোষ বইটির নাম- 'Vocabolario em idioma Bengalla e Portuguez em duas partes' এটিকে বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ ও শব্দকোষ বলা হয়। 

নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থটির নাম-'A Grammar of the Bengal Language'এটিকে ভাষার প্রথম আদর্শ ব্যাকরণ হিসেবেবে ধরা হয়। গ্রন্থটির অংশবিশেষ বাংলায় চার্লস উইলকিনসের হুগলির মুদ্রণযন্ত্র থেকে মুদ্রিত হয়। ব্রাসি হ্যালহেড সর্বপ্রথম বাংলা টাইপ সহযােগে বাংলা ব্যাকরণ মুদ্রণ করেন |২৬তম বিসিএস)। 

এগুলাে বাংলা গদ্য সৃষ্টির পথে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখলেও উনিশ শতকের পূর্বে সাহিত্যে বাংলার প্রবেশ তেমন একটা পড়ে না। তাই বাংলা সাহিত্যে গদ্যের সূচনাকাল ধরা হয় উনিশ শতককে [২৮তম বিসিএস)। 

শ্রীরামপুর মিশন - 

শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠিত হয় ১০ জানুয়ারি, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে

উইলিয়াম কেরি ১৭৯৩ সালে কলকাতায় আগমন করেন এবং ডেনমার্কের শাসনাধীন শ্রীরামপুরে উইলিয়াম ওয়ার্ড ও জোশুয়া মার্শম্যানের সহযােগে ব্যাপ্টিস্ট মিশন এবং মিশনের মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করেন। তবে উপমহাদেশের প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় (পর্তুগিজ ভাষার মুদ্রণযন্ত্র) ১৪৯৮ সালে। চার্লস উইলকিন্স হুগলিতে প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে।

কলকাতার শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় সম্পাদিত পত্রিকার নাম : ক. দিগদর্শন (মাসিক) (এপ্রিল মাসে), খ. সমাচার দৰ্পণ (মে মাসে)।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ 

১৬৯৮ সালে কলকাতায় ইংল্যান্ডের ৩য় রাজা উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মিত হয়। 

প্রতিষ্ঠাতা : স্যার চার্লস আইয়ার।  

বাংলা গদ্য সাহিত্য বিকাশে ফোার্ট উইলিয়াম কলেজের বিশেষ অবদান রয়েছে। 

বাংলাদেশে কর্মরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারীদের দেশীয় ভাষায় শিক্ষাদানের ইংরেজ শাসিত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি কর্তৃক ১৮০০ খ্রি: ১০ জুলাই কলকাতার লালবাজারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা : উইলিয়াম কেরি। 

১৮০১ সালের ৪ঠা মে কলেজে প্রতিষ্ঠিত হলেও ২৪ শে নভেম্বর থেকে কলেজের কাজ শুরু হয়েছিল।

ওয়েলেসলি অনুভব করেছিলেন যে, কোম্পানীর দায়িত্বপূর্ণ| কাজের ভার নিয়ে বিলাত থেকে যারা আসে, তারা অধিকাংশ চৌদ্দ থেকে আঠারাে বৎসরের নাবালক, স্বদেশে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন হয়নি। এ দেশেও তাদের কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই দেশীয় ভাষা শিক্ষা দিয়ে এই সিভিলিয়ানদের উপযুক্ত করে তােলার জন্যই ফোর্ট উইলিয়ামের প্রতিষ্ঠা। 

এই কলেজে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিভাগ প্রবর্তিত [২৬তম বিসিএস) হলে অধ্যক্ষ হিসেবে আসেন শ্রীরামপুর মিশনের পাদ্রি এবং বাইবেলের বাংলা অনুবাদক বাংলায় অভিজ্ঞ উইলিয়াম কেরি। ফলে বাংলা ভাষা তাঁর নিকট চিরঋণী হয়ে রয়েছে। তিনি তার অধীনস্থ দুই জন পণ্ডিত এবং ৬ জন সহকারী পণ্ডিত (মােট ৮ জন পণ্ডিত)-এর সহযােগিতায় কলেজের পাঠোপযােগী পুস্তক রচনায় আত্মনিয়ােগ করেন। 

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকবৃন্দ ১৮০১ - ১৮১৫ সাল পর্যন্ত ১৪ টি বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যাদের মধ্যে উইলিয়াম কেরি, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার, রামরাম বসু, গােলকনাথ শৰ্মা ও চন্ডীচরণ মুনসী অন্যতম। 

উইলিয়াম কেরি

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাণপুরুষ। ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সােসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আধুনিক মিশনসমূহের Gpal (Father of modern missions) a ao উইলিয়াম কেরি ১৭৯৩-১৭৯৬ সাল পর্যন্ত রামরাম বসুর নিকট হতে বাংলা শিখেছিলেন। এজন্য রামরাম বসুকে কেরি সাহেবের মুন্সী বলা হয়। কেরি ১৮০৯ সালে বাংলায় বাইবেল অনুবাদ করেন। ১৮১০ সালে দরিদ্র খ্রিস্টান সন্তানদের জন্য কলকাতায় বাের্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। 

সাহিত্যকর্ম কৌশলে মনে রাখুন : কেরী কই। 

কথােপকথন, ইতিহাসমালা 

ক-কথোপকথন (১৮০১, বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ) এবং 

ই-ইতিহাসমালা (বাংলা সাহিত্যের প্রথম গল্পগ্রন্থ)।


মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার

তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক এবং তিনি সবচেয়ে বেশি গরন্থ রচনা করেন। 

তাঁর লেখা গ্রন্থসমূহ- প্রবােধ চন্দ্রিকা (১৮৩৩) ০ রাজাবলি (১৮০৮) হিতােপদেশ (১৮০৮) বত্রিশ সিংহাসন (১৮০২) (২৬তম বিসিএস) 

ভুলেও যেন ভুল না হয় : বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার : রাজা রামমােহন রায় রচিত। বেদান্ত চন্দ্রিকা (১৮১৭) 

রামরাম বসু 

১৮০১ সালের ৪ মে রামরাম বসু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে নিযুক্ত হন। [৩৮তম বিসিএস) তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার চর্চা করেন। তাঁকে কেরী সাহেবের মুনশি বলা হয়। 

রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র (১৮০১) [৩৬তম বিসিএস) : বাঙ্গালির লেখা বঙ্গাক্ষরে মুদ্রিত প্রথম মৌলিক গ্রন্থ। গদ্যে লিখিত প্রথম জীবনচরিত। 

লিপিমালা (১৮০২) : প্রথম বাংলা পত্র সাহিত্য।

গােলকনাথ শৰ্মা 

তিনি কলেজের শিক্ষক না হয়েও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হিতােপদেশ (১৮০১) : ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যরূপে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এটি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ। 

চণ্ডীচরণ মুনশী 

তােতা ইতিহাস অনুবাদ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্র (১৮০৫) - ফারসী হতে 

রাজীব লােচন মুখােপাধ্যায় 

পুরুষ পরীক্ষা (১৮১৫)। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সর্বশেষ রচনা। ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট। 

লাল্লুলাল

 হিন্দি খড়িবােলি গদ্যের জনক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দুস্তানি ভাষা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৮১৫ সালে আদি হিন্দি সাহিত্যের প্রথম বই তুলসীদাসের বিনয় পত্রিকা মুদ্রণ ও প্রকাশ হরপ্রসাদ রায় মুনসী তারিনীচরণ মিত্র লালুলাল ইন করেন।

 ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ ১৮৪৬ সাল পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড ৯১) ১৮৪১ থেকে পণ্ডিত ছিলেন। 

মদনমােহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭ উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করতেন।

 বিগত বছরের প্রশ্ন 

০১. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ কে ছিলেন? উত্তর : উইলিয়াম কেরি। (৩৪তম বিসিএস) 

০২. ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খােলা হয় - উত্তর : ১৮০১ সালে। (২৬তম বিসিএস) 

তথ্যসূত্র : বাংলা পিডিয়া, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম, সাহিত্য জিজ্ঞাসা- সৌমিত্র শেখর ও উইকিপিডিয়া। 

এটাই ছিল বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের আলোচনা।

পরবর্তীতে আলোচনা করা হবে:

১.বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিবর্তন

২.বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব আলোচনা কর

৩.বাংলা ভাষায় গদ্যরীতির সূচনা হয় কোন যুগে

৪.বাংলা গদ্যের সূচনা হয় কবে

৫.বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে বিদ্যাসাগরের অবদান

৬.বাংলা গদ্য সাহিত্যে রামমোহন রায়ের অবদান





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url